জাতীয় ঐক্যের সন্ধানে বাংলাদেশ: একাত্তরের চেতনায় ফিরে যাওয়ার আহ্বান
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের জাতি যে অসাধারণ ঐক্য প্রদর্শন করেছিল, আজ সেই একই ঐক্যের প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছে। জাতীয় ঐক্য শুধু একটি আদর্শ নয়, এটি একটি দেশের স্থিতিশীলতা, সামাজিক শান্তি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল ভিত্তি।
একাত্তরের শিক্ষা: ঐক্যেই শক্তি
ইতিহাস আমাদের শেখায়, জাতি যত ঐক্যবদ্ধ হয়, দেশের সম্ভাবনা তত বৃদ্ধি পায়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ তার উজ্জ্বল প্রমাণ। তখন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সামরিকভাবে ঐক্যবদ্ধ জাতি স্বাধীনতা অর্জনে সক্ষম হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সমগ্র জাতি এক হয়ে দাঁড়িয়েছিল পাকিস্তানি শোষকদের বিরুদ্ধে।
কিন্তু স্বাধীনতার পর রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতার লড়াই, স্বার্থপরতা ও অবিশ্বাস দেশের স্থিতিশীলতা ও সংহতিকে বিপন্ন করেছে। ১৯৭৫ সালের পর থেকে দলগুলো সংবিধান ও প্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে।
ফ্যাসিবাদী শাসনের ক্ষত
গত ১৫ বছরে ফ্যাসিবাদী শাসন সংবিধান, আইন ও প্রশাসনকে নিজের নিয়ন্ত্রণে এনেছে। বিচারব্যবস্থা, সংবাদমাধ্যম ও নির্বাচন কমিশনে পক্ষপাত বেড়েছে। র্যাব, ডিজিএফআই ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বিরোধী মত দমনে ব্যবহার করা হয়েছে। গুম, খুন ও নির্যাতন সাধারণ ঘটনা হয়েছে।
এতে প্রাতিষ্ঠানিক স্বতন্ত্রতা, সামাজিক মূল্যবোধ ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো রাজনৈতিক চাপের মুখে দায়িত্ব ও স্বচ্ছতা হারিয়েছে।
জুলাই বিপ্লব: নতুন সম্ভাবনার দ্বার
জুলাই বিপ্লব প্রমাণ করেছে যে, রাজনৈতিক দল ও জনগণ যখন ঐক্যবদ্ধ হয়, তখন দেশের জন্য বড় ধরনের পরিবর্তন সম্ভব। এই বিপ্লব আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় একাত্তরের সেই অগ্নিঝরা দিনগুলোর কথা, যখন সমগ্র জাতি এক হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
জুলাই সনদে সংবিধান, আইন এবং প্রশাসনিক কাঠামো পুনর্গঠনের জন্য সুস্পষ্ট ধারা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তবে বিএনপি কিছু ধারায় নোট অব ডিসেন্ট প্রকাশ করেছে, যা প্রমাণ করে রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঐক্য অর্জন এখনো চ্যালেঞ্জিং।
সার্বভৌমত্বের হুমকি
ঐক্যহীনতার সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো দেশের সার্বভৌমত্বের হুমকি। যখন রাজনৈতিক দলগুলো বিভক্ত এবং প্রশাসন পক্ষপাতমূলক হয়, তখন প্রতিবেশী শক্তিগুলো, বিশেষ করে ভারত, দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সুযোগ নিয়ে আধিপত্য বিস্তার করতে পারে।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, ১৯৭১ সালে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম বহু ত্যাগের বিনিময়ে। সেই স্বাধীনতা রক্ষার জন্য আজও আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।
এগিয়ে যাওয়ার পথ
দেশের ভবিষ্যৎ শুধু রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্য, সংবিধান ও আইনকে কার্যকরভাবে প্রতিষ্ঠা এবং জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের ওপর নির্ভর করছে। জাতিকে সতর্ক হতে হবে, নিজেদের পার্থক্য ভুলে দেশের স্বার্থকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিতে হবে।
একটি জাতীয় সংলাপের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি, যেখানে সব রাজনৈতিক শক্তি, নাগরিক সমাজ, নির্বাচন কমিশন অংশ নেবেন। রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত হবে সহনশীলতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও জাতীয় ঐক্যের মানসিকতা গড়ে তোলা।
শুধু এভাবেই বাংলাদেশ একটি স্থিতিশীল, সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে এগোতে পারবে, যা আগামী প্রজন্মের জন্য সমৃদ্ধি, শান্তি এবং নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেবে। একাত্তরের চেতনায় আজও আমাদের এক হতে হবে, দেশের স্বার্থে।