জাতীয় ঐক্যের সংকট: ১৯৭১ এর চেতনায় ফিরে যাওয়ার আহ্বান
জাতীয় ঐক্য একটি দেশের স্থিতিশীলতা, সামাজিক শান্তি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল ভিত্তি। ইতিহাস আমাদের দেখায়, জাতি যত ঐক্যবদ্ধ হয়, দেশের সম্ভাবনা তত বৃদ্ধি পায়। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ তার উজ্জ্বল প্রমাণ। তখন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সামরিকভাবে ঐক্যবদ্ধ জাতি স্বাধীনতা অর্জনে সক্ষম হয়েছিল।
স্বাধীনতা পরবর্তী বিভাজনের শুরু
কিন্তু স্বাধীনতার পর রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতার লড়াই, স্বার্থপরতা ও অবিশ্বাস দেশের স্থিতিশীলতা ও সংহতিকে বিপন্ন করেছে। ১৯৭৫ সালের পর থেকে দলগুলো সংবিধান ও প্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। ১৯৯০ সালের গণ আন্দোলনের পরও তারা জাতীয় স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি, যা দীর্ঘমেয়াদি বিপদের সূচনা করে।
ফ্যাসিবাদী শাসনের কুপ্রভাব
গত ১৫ বছরে ফ্যাসিবাদী শাসন সংবিধান, আইন ও প্রশাসনকে নিজের নিয়ন্ত্রণে এনেছে। বিচারব্যবস্থা, সংবাদমাধ্যম ও নির্বাচন কমিশনে পক্ষপাত বেড়েছে। র্যাব, ডিজিএফআই ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বিরোধী মত দমনে ব্যবহার করা হয়েছে। গুম, খুন ও নির্যাতন সাধারণ ঘটনা হয়েছে।
এতে প্রাতিষ্ঠানিক স্বতন্ত্রতা, সামাজিক মূল্যবোধ ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো রাজনৈতিক চাপের মুখে দায়িত্ব ও স্বচ্ছতা হারিয়েছে।
জুলাই বিপ্লব ও নতুন আশার সঞ্চার
জুলাই বিপ্লব প্রমাণ করেছে যে, রাজনৈতিক দল ও জনগণ যখন ঐক্যবদ্ধ হয়, তখন দেশের জন্য বড় ধরনের পরিবর্তন সম্ভব। এ প্রচেষ্টার অন্যতম শীর্ষ দিক হলো জুলাই সনদ, যা রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে তৈরি হয়েছে।
জুলাই সনদে সংবিধান, আইন এবং প্রশাসনিক কাঠামো পুনর্গঠনের জন্য সুস্পষ্ট ধারা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তবে বিএনপি কিছু ধারায় নোট অব ডিসেন্ট প্রকাশ করেছে, যা প্রমাণ করে রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঐক্য অর্জন এখনো চ্যালেঞ্জিং।
সার্বভৌমত্বের হুমকি ও বিদেশি প্রভাব
ঐক্যহীনতার সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো দেশের সার্বভৌমত্বের হুমকি। যখন রাজনৈতিক দলগুলো বিভক্ত এবং প্রশাসন পক্ষপাতমূলক হয়, তখন প্রতিবেশী শক্তিগুলো, বিশেষ করে ভারত, দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সুযোগ নিয়ে আধিপত্য বিস্তার করতে পারে।
আন্তর্জাতিক প্রভাব দেশের স্বাধীন সার্বভৌমত্বের জন্য উদ্বেগজনক। আমাদের স্মরণ রাখতে হবে, ১৯৭১ সালে আমরা যে স্বাধীনতা অর্জন করেছি, তা রক্ষা করতে হলে জাতীয় ঐক্য অপরিহার্য।
রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান ও সংকট
বিএনপি ও তাদের সমমনা দল চাচ্ছে বর্তমান প্রচলিত পদ্ধতিতে নির্বাচন এবং জাতীয় নির্বাচনের দিনেই গণভোট আয়োজন। অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামী ও অন্যান্য ইসলামপন্থি দল আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক (পিআর) পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচন এবং জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দেওয়ার জন্য গণভোট জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে করার বিষয়ে অটল।
এই অচলাবস্থা দেশকে গভীর সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা সামাজিক বিভাজন, গৃহযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ ও অরাজকতা সৃষ্টি করতে পারে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঐক্যের আহ্বান
জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে, আমাদের ফিরে যেতে হবে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়। যেমনভাবে আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বাধীনতা এনেছিলেন, তেমনি আজও আমাদের জাতীয় স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির যে ঐতিহ্য আমাদের স্বাধীনতার মূল ভিত্তি, সেই ঐতিহ্যকে রক্ষা করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের পার্থক্য ভুলে দেশের স্বার্থকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিতে হবে।
উত্তরণের পথ
এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য জরুরি হলো একটি জাতীয় সংলাপের উদ্যোগ নেওয়া। সংলাপের মাধ্যমে গণভোট ও নির্বাচনের সময়সূচি, পদ্ধতি ও তদারকি ব্যবস্থায় একটি সমঝোতা গড়ে তোলা যেতে পারে।
রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত হবে সহনশীলতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও জাতীয় ঐক্যের মানসিকতা গড়ে তোলা। কারণ রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা দলীয় জয়ের চেয়ে অনেক বড় লক্ষ্য।
শুধু এভাবেই বাংলাদেশ একটি স্থিতিশীল, সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে এগোতে পারবে, যা আগামী প্রজন্মের জন্য শান্তি, সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই আমাদের পথ দেখাবে।