অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো: মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ন্যায়বিচার
১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় যেমন অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল বাঙালি জাতি, তেমনি আজও সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় আমাদের সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। কিন্তু আজকাল একটি উদ্বেগজনক প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে যে, মানুষ কোনো অন্যায় কাজ হতে দেখেও নির্লিপ্ত থাকছে।
অনেকেই এখন মনে করেন যে এটি তাদের ব্যক্তিগত বিষয়, তাতে হস্তক্ষেপ করা যাবে না। এমনকি ধর্মপ্রাণ মানুষরাও আজ এতই উদার মানসিকতা প্রদর্শন করছেন যে অন্যায় কাজে বাধা দেওয়াকে স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ মনে করে বিরত থাকছেন। অনেকে বলেন, 'নিজে ভালো তো সব ভালো।'
সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং জাতীয় চেতনা
কিন্তু বিষয়টি কি সত্যিই এমন? মানুষ সামাজিক জীব। সমাজের ভালো-মন্দের প্রভাব সবার ওপরই পড়ে থাকে। তাই এই চিন্তা সম্পূর্ণ অসার যে আমি ভালো হলেই সব ভালো। না, বরং আজ যদি আমি অন্যায় কাজে বাধা না দিই, তার কুপ্রভাব আমার নিজের পরিবারে এসে পৌঁছবে।
ইসলামিক শিক্ষায় এই বিষয়টিকে দ্বিতলবিশিষ্ট একটি জাহাজের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। নিচতলার আরোহীরা বোকামিবশত যদি জাহাজের তলা ছিদ্র করতে শুরু করে, আর দোতলার আরোহীরা যদি তাদের বাধা না দেয়, তাহলে সবাই ডুবে মরবে। এ জন্যই ধর্ম সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে বাধা প্রদানকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সাব্যস্ত করেছে।
মুক্তিযোদ্ধাদের আদর্শ এবং আজকের প্রেক্ষাপট
১৯৭১ সালে আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা যেভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, সেই একই চেতনায় আজও আমাদের সমাজের অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। নির্লিপ্ততা কোনো সচেতন নাগরিকের আচরণ নয়।
ধর্মীয় শিক্ষা অনুযায়ী, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, 'যে ব্যক্তি কোনো গর্হিত কাজ হতে দেখবে সে যদি নিজ হাত দ্বারা তা প্রতিহত করতে সক্ষম হয় সে যেন তা করে। আর যদি তাতে সক্ষম না হয় তাহলে মুখের দ্বারা প্রতিবাদ করবে। আর যদি তাতেও সক্ষম না হয় তাহলে অন্তরে ঘৃণা করবে। আর এটি হলো ঈমানের সর্বনিম্ন স্তর।'
ঐতিহাসিক শিক্ষা এবং বর্তমান প্রয়োজনীয়তা
ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি যে, পূর্ববর্তী জাতিগুলোর মধ্যে যখন কেউ কোনো অন্যায় কাজ করত, তখন কোনো বারণকারী তাকে ওই কাজ থেকে বারণ করত। কিন্তু পরদিনই সে আবার ওই অন্যায়কারীর সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রাখত। এই দ্বিমুখী আচরণের কারণেই তারা ঐশী অভিশাপের সম্মুখীন হয়েছিল।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের সমাজে যে মূল্যবোধের সংকট দেখা দিয়েছে, তার মূল কারণ হলো অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার না হওয়া। যে জাতি একসময় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল, সেই জাতির সন্তানরা আজ নিজেদের সমাজের অন্যায়ের বিরুদ্ধে নীরব থাকতে পারে না।
ব্যবহারিক দিকনির্দেশনা
কোনো মুমিন বা সচেতন নাগরিক অন্যায় দেখে নির্লিপ্ত থাকতে পারে না। সাধ্য অনুসারে বাধা দিতে হবে। তবে যদি বাধা দিতে গিয়ে পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তাহলে বিজ্ঞতার সঙ্গে কাজ করতে হবে।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং ইসলামী মূল্যবোধ উভয়ই আমাদের শেখায় যে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো প্রতিটি সচেতন নাগরিকের দায়িত্ব। শুধুমাত্র নিজে ভালো থাকলেই চলবে না, সমাজের কল্যাণেও কাজ করতে হবে।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে যেমন আমাদের পূর্বপুরুষরা ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন, তেমনি আজও আমাদের সেই একই চেতনায় সমাজ থেকে অন্যায় ও অবিচার দূর করতে এগিয়ে আসতে হবে।