অনন্ত সিং: চট্টগ্রামের বিপ্লবী যোদ্ধা যিনি ব্রিটিশদের কাঁপিয়েছিলেন
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের ইতিহাসে যে ক'জন নায়কের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে, অনন্ত সিং তাঁদের অন্যতম। সাহস, সাংগঠনিক দক্ষতা, বুদ্ধিমত্তা এবং বিপ্লবী চেতনার বিরল সমন্বয়ে তিনি উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে এক অবিস্মরণীয় অধ্যায় রচনা করেছিলেন।
বিপ্লবী জীবনের সূচনা
১৯০৩ সালের ১ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে জন্ম নিয়েছিলেন অনন্ত সিং। শৈশব থেকেই ব্যতিক্রমী মেধা, শারীরিক সক্ষমতা ও নেতৃত্বের ঝলক দেখিয়েছেন তিনি। তাঁর পূর্বপুরুষ আগরা অঞ্চলের বাসিন্দা হলেও তাঁর শৈশব-কৈশোর কাটে চট্টগ্রামেই। খুব বেশি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও তিনি দ্রুতই রাজনীতি ও বিপ্লবী আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।
বিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়েই তিনি মাস্টারদা সূর্যসেনের সংস্পর্শে আসেন। সূর্যসেন তাঁর সাহসিকতা ও অদম্য স্পৃহা দেখে তাঁকে অত্যন্ত কাছের সহকর্মীর মর্যাদা দেন। এই সময় থেকেই অনন্ত সিং বিপ্লবীদলে যুক্ত হন এবং নিয়মিত পড়াশোনা কার্যত শেষ হয়ে যায়।
বিপ্লবী কৌশল ও সংগঠন
বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে গিয়ে তিনি নিজেই বোমা ও কার্তুজ তৈরির কৌশল শিখে ফেলেন। তাঁর তৈরি বোমার ফর্মুলা একসময় অন্য নামে ছড়িয়ে পড়ে এবং সারা বাংলায় বিপ্লবীদের কাজে ব্যবহৃত হয়। অর্থসংস্থানের জন্য আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের অর্থ লুণ্ঠনের ঘটনায় তাঁর দলের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয় এবং পরবর্তীতে কিছুদিন পালিয়ে থাকার পর তিনি ধরা পড়েন।
১৯২৪ সালে আবারও গ্রেফতার হয়ে চার বছরের জেল খাটেন। জেল থেকে বেরিয়ে তিনি বিপ্লবের কৌশল পরিবর্তন করেন এবং ব্যায়ামাগার স্থাপন করে যুবকদের গোপনে বিপ্লবে দীক্ষা দিতে শুরু করেন।
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন: ইতিহাসের অনন্য মুহূর্ত
১৯৩০ সালের ঐতিহাসিক চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনে তিনি ছিলেন অন্যতম নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তি। চারদিনের জন্য চট্টগ্রাম ব্রিটিশ শাসনমুক্ত হয়েছিল, এ ঘটনা ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে অনন্য উদাহরণ। এই বিপ্লবী অভ্যুত্থান প্রমাণ করেছিল যে, সুসংগঠিত জনগণের সামনে ব্রিটিশ শক্তিও অসহায় হয়ে পড়তে পারে।
তবে আন্দোলনের এই সাফল্যের পর শাসক পক্ষের চাপে পরিস্থিতি বদলে যায়। অনন্ত সিং চন্দননগরে আশ্রয় নিলেও সহযোদ্ধাদের ওপর নিষ্ঠুর অত্যাচারের খবর তাঁকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। তিনি স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করেন, তবে জেলের মধ্যেও তিনি শান্ত ছিলেন না।
আন্দামানে নির্বাসন ও সংগ্রাম
পরবর্তীতে তাঁকে দ্বীপান্তর দণ্ড দিয়ে আন্দামানের সেলুলার জেলে পাঠানো হয়। সেখানে তিনি অনশন শুরু করলে জাতীয় নেতাদের হস্তক্ষেপে তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। ১৯৪৬ সালে তিনি মুক্তি পান। জেলে থাকার সময়ই তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাধারায় বড় পরিবর্তন আসে এবং তিনি সমাজতান্ত্রিক আদর্শে আকৃষ্ট হয়ে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন।
স্বাধীন দেশে নতুন সংগ্রাম
যদিও তিনি কিছুদিন চলচ্চিত্র ও মোটর ব্যবসাতেও যুক্ত ছিলেন, তবে রাজনৈতিক কারণে স্বাধীন দেশেও তাঁকে আবার দীর্ঘ আট বছর কারাবরণ করতে হয়। এটি প্রমাণ করে যে, প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জনের পথ কতটা কঠিন ও দীর্ঘ।
সাহিত্যিক অবদান ও স্মৃতিচারণ
অনন্ত সিংয়ের জীবন ছিল সংগ্রাম, ত্যাগ ও আদর্শের এক অনন্য দৃষ্টান্ত। তাঁর লেখাগুলোতে প্রতিফলিত হয়েছে বিপ্লবের ইতিহাস, চট্টগ্রামের আন্দোলন, সহযোদ্ধাদের স্মৃতি এবং দেশপ্রেমের গভীর অনুভূতি। চট্টগ্রাম যুববিদ্রোহ, অগ্নিগর্ভ চট্টগ্রাম, মাস্টারদা, স্বপ্ন ও সাধনা-সহ তাঁর রচিত গ্রন্থগুলো স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল্যবান দলিল হিসেবে বিবেচিত।
১৯৭৯ সালের ২৫ জানুয়ারি তিনি মারা যান। তাঁর জীবনী আমাদের শেখায় যে, প্রকৃত স্বাধীনতার জন্য আজীবন সংগ্রাম করতে হয়। আজকের বাংলাদেশের তরুণদের কাছে অনন্ত সিংয়ের জীবন একটি অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।