অনন্ত সিং: চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের অবিস্মরণীয় বীর
১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের যে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের অমর অধ্যায়, তার অন্যতম নায়ক অনন্ত সিং। মাস্টারদা সূর্যসেনের বিপ্লবী সেনাদলের প্রধান এই বীর যোদ্ধা শুধুমাত্র ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামেই নয়, স্বাধীনতার পরও আমাদের মাতৃভূমির জন্য সংগ্রাম করেছেন।
বিপ্লবী চেতনার জন্ম
১৯০৩ সালের ১ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণকারী অনন্ত সিং শৈশব থেকেই ব্যতিক্রমী মেধা ও নেতৃত্বের গুণাবলী প্রদর্শন করেন। বিদ্যালয়ে পড়াকালীনই তিনি মাস্টারদা সূর্যসেনের সংস্পর্শে আসেন এবং তাঁর সাহসিকতা দেখে সূর্যসেন তাঁকে অত্যন্ত কাছের সহকর্মী হিসেবে গ্রহণ করেন।
খুব অল্প বয়সেই তিনি রাজনৈতিক আন্দোলনে সচেতন হয়ে ওঠেন এবং স্কুলের সহপাঠীদের নেতৃত্ব দিয়ে অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করান। তাঁর খেলাধুলা ও শরীরচর্চার অভ্যাস তাঁকে বিপ্লবী কাজকর্মের জন্য আরও উপযুক্ত করে তোলে।
বিপ্লবী কর্মকাণ্ড ও সংগঠন
বিপ্লবী দলে যুক্ত হওয়ার পর অনন্ত সিং নিজেই বোমা ও কার্তুজ তৈরির কৌশল আয়ত্ত করেন। তাঁর তৈরি বোমার ফর্মুলা সারা বাংলার বিপ্লবীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। অর্থসংস্থানের জন্য আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের অর্থ লুণ্ঠনের ঘটনায় পুলিশের সাথে সংঘর্ষের পর তিনি ১৯২৪ সালে গ্রেফতার হন এবং চার বছরের কারাদণ্ড ভোগ করেন।
জেল থেকে মুক্তির পর তিনি কৌশল পরিবর্তন করে ব্যায়ামাগার স্থাপন করেন এবং যুবকদের গোপনে বিপ্লবী আদর্শে দীক্ষিত করতে শুরু করেন। তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতা ও পরিকল্পনা পরবর্তীকালে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের সাফল্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ঐতিহাসিক চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন
১৯৩০ সালের ঐতিহাসিক চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনে অনন্ত সিং ছিলেন অন্যতম প্রধান নেতা। এই অভিযানের ফলে চারদিনের জন্য চট্টগ্রাম ব্রিটিশ শাসনমুক্ত হয়েছিল যা ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক অনন্য ঘটনা।
এই সাফল্যের পর ব্রিটিশ সরকারের নিষ্ঠুর দমনপীড়নের মুখে অনন্ত সিং চন্দননগরে আশ্রয় নিলেও সহযোদ্ধাদের ওপর অত্যাচারের খবর পেয়ে তিনি স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করেন। জেলের মধ্যেও তিনি নিস্ক্রিয় থাকেননি এবং সুড়ঙ্গ কেটে জেল ভাঙার পরিকল্পনা করেন।
আন্দামানে নির্বাসন ও সংগ্রাম অব্যাহত
পরবর্তীতে তাঁকে দ্বীপান্তর দণ্ড দিয়ে আন্দামানের সেলুলার জেলে পাঠানো হয়। সেখানে তিনি অনশন শুরু করলে জাতীয় নেতাদের হস্তক্ষেপে তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। ১৯৪৬ সালে তিনি মুক্তি পান।
জেলে থাকার সময় তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাধারায় পরিবর্তন আসে এবং তিনি সমাজতান্ত্রিক আদর্শে আকৃষ্ট হয়ে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। স্বাধীন ভারতেও রাজনৈতিক কারণে তাঁকে আরও আট বছর কারাভোগ করতে হয়।
সাহিত্যিক অবদান ও উত্তরাধিকার
অনন্ত সিংয়ের জীবন ছিল সংগ্রাম, ত্যাগ ও আদর্শের এক অনন্য দৃষ্টান্ত। তাঁর রচিত গ্রন্থগুলোতে প্রতিফলিত হয়েছে বিপ্লবের ইতিহাস, চট্টগ্রামের আন্দোলন ও সহযোদ্ধাদের স্মৃতি। চট্টগ্রাম যুববিদ্রোহ, অগ্নিগর্ভ চট্টগ্রাম, মাস্টারদা, স্বপ্ন ও সাধনা সহ তাঁর রচিত গ্রন্থগুলো স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল্যবান দলিল।
১৯৭৯ সালের ২৫ জানুয়ারি এই মহান বিপ্লবী পরলোকগমন করেন। তাঁর জীবন ও সংগ্রাম আজও আমাদের অনুপ্রেরণা যোগায় এবং প্রমাণ করে যে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য আমাদের পূর্বসূরিরা কতটা ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন।