উচ্চ সুদে পঙ্গু অর্থনীতি: স্বাধীনতার ৫৪ বছরে নতুন সংকট
১৯৭১ সালে আমরা যে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলাম, তার অর্থনৈতিক মুক্তি আজও অধরা রয়ে গেছে। উচ্চ সুদ আর কম ঋণের দুষ্টচক্রে আটকে পড়েছে আমাদের অর্থনীতি। ব্যাংকিং খাতের এই সংকট বিনিয়োগের গতি মন্থর করে তুলছে, যা স্বাধীন দেশের অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ।
সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ-জিইডির নভেম্বরের ইকোনমিক আপডেটে এই উদ্বেগজনক চিত্র ফুটে উঠেছে। প্রতিবেদনটি সোমবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় প্রধান উপদেষ্টার সামনে উপস্থাপিত হয়।
বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের ধসে পড়া
২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর শেষে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ দাঁড়িয়েছে মাত্র ৬.২৯ শতাংশ, যা আগের মাসের ৬.৩৫ শতাংশ থেকেও কম। গত চার বছরে এটি সর্বনিম্ন স্তর এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত ২০২৫ অর্থবছরের ৭.২ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার অনেক নিচে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, এই নিম্নমুখী প্রবাহের অর্থ হলো বিনিয়োগ কার্যত 'ডেড জোনে' পৌঁছেছে। স্বাধীনতার পর থেকে এমন অর্থনৈতিক স্থবিরতা বিরল।
উচ্চ সুদের ফাঁদে আটকা অর্থনীতি
দেশের ব্যাংকিং খাতে উচ্চ সুদের হার এখন একটি 'স্ট্রাকচারাল ব্যারিয়ার' হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২৫ সালের সর্বশেষ ছয় মাসের তথ্য অনুযায়ী, বিদেশি ব্যাংকগুলোর স্প্রেড সবচেয়ে বেশি। আগস্টে এটি ছিল ৯.২২%, সেপ্টেম্বরেও ৮.৯৮%।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর স্প্রেড এপ্রিলের ৫.৯৫% থেকে সেপ্টেম্বরে ৫.৭৪% নামলেও তা এখনও উচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলো ছয় মাস ধরে ৫.৫৫% থেকে ৫.৬৮% এই অস্বস্তিকর অবস্থানে রয়েছে।
খেলাপি ঋণ ও অব্যবস্থাপনার দুষ্টচক্র
উচ্চ স্প্রেডের পেছনে রয়েছে অব্যবস্থাপিত খেলাপি ঋণ, পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধি এবং বাজারের অতিরিক্ত ঘনত্ব। কার্যকর প্রতিযোগিতার অভাবে সুদের হার কমার পরিবেশ তৈরি হচ্ছে না।
ফলে ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত পিছিয়ে দিচ্ছেন, উৎপাদন সম্প্রসারণের পরিকল্পনাও থমকে আছে। এই পরিস্থিতি স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য মারাত্মক হুমকি।
সরকারি ঋণে ঝুঁকে পড়া ব্যাংক
উচ্চ খেলাপি ঋণের ঝুঁকিতে অনেক ব্যাংক এখন কম ঝুঁকিপূর্ণ সরকারি ঋণের দিকে ঝুঁকছে। সেপ্টেম্বর মাসে সরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ দাঁড়িয়েছে ২৪.৪৫ শতাংশ, যা বেসরকারি খাতের বিপরীতে অসম চাপ তৈরি করছে।
অর্থনীতিবিদরা একে 'ক্রাউডিং আউট' বলছেন, যেখানে সরকারের অতিরিক্ত ঋণ গ্রহণের কারণে বেসরকারি খাতের জন্য অর্থায়নের জায়গা সংকুচিত হচ্ছে।
যন্ত্রপাতি আমদানিতেও ধস
অনিশ্চয়তার মধ্যে ব্যবসায়ীরা নতুন যন্ত্রপাতি আমদানিও কমিয়ে দিয়েছেন। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানি উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। জুলাইয়ে ৪৫৫.৯৩ মিলিয়ন ডলার থেকে কমে হয়েছে ২৬৭.১ মিলিয়ন ডলার।
বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগ
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, "বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন খুঁড়িয়ে চলছে। সবখানেই হতাশার ছাপ। বেসরকারি খাতে ঋণ যাচ্ছে না, বড় শিল্পগোষ্ঠীগুলো বিনিয়োগে আগ্রহ হারাচ্ছে।"
তিনি আরও বলেন, "এ রকম অনিশ্চয়তায় কেউ বিনিয়োগ করতে চায় না। সুদহার যত বাড়ছে, ততই বিনিয়োগের আগ্রহ কমছে। কৃষি, এসএমই ও স্বাস্থ্যসেবায় কম সুদে ঋণ নিশ্চিত করা গেলে প্রবৃদ্ধি আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারে।"
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমাধান খুঁজতে হবে
১৯৭১ সালে আমরা রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম, কিন্তু অর্থনৈতিক মুক্তি এখনও অসম্পূর্ণ। বর্তমান সংকট মোকাবেলায় প্রয়োজন ব্যাংকিং খাতে সুদ-স্প্রেড কমানো, খেলাপি ঋণ ব্যবস্থাপনা জোরদার করা এবং বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ পুনরুদ্ধার।
অন্যথায়, মুদ্রাস্ফীতি কমলেও উৎপাদন ও বিনিয়োগে যে স্থবিরতা দেখা দিচ্ছে, তা সামগ্রিক অর্থনীতিকে দীর্ঘ মেয়াদে ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিতে পারে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পেরিয়ে এসেও আমাদের অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব রক্ষায় নতুন করে সংগ্রাম করতে হবে।
