দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার জন্য জাতির প্রার্থনা
বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের ইতিহাসে জিয়া পরিবার এমন একটি নাম, যাদের ত্যাগ, অবদান ও নির্যাতন ভোগের বর্ণনা একই সূত্রে গাঁথা। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান মহান মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক ও দেশের স্বাধীনতার রূপকার হিসেবে যে রাজনৈতিক যাত্রা শুরু করেছিলেন, তা দ্রুতই রূপ নেয় একটি সম্ভাবনাময় রাষ্ট্রের ভিত্তি গড়ার মহাকর্মযজ্ঞে।
জিয়াউর রহমানের অবদান ও আততায়ীদের হাতে শাহাদাত
বাকশালের একদলীয় শাসন বাতিল করে তিনি বহুদলীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনেন। স্বাধীন গণমাধ্যমের শক্তি ফিরিয়ে দেন এবং কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, পররাষ্ট্রনীতি প্রতিটি ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী সংস্কার চালান। তলাবিহীন ঝুড়ির অপবাদে আখ্যায়িত বাংলাদেশের অর্থনীতিকে তিনি উন্নয়নের সোপানে তোলেন। ফলে দেশি-বিদেশি অনেক শক্তিই আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত সেই আতঙ্ক থেকেই ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে একদল বিপথগামী সেনা কর্মকর্তারা তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
বেগম খালেদা জিয়ার অদমনীয় সংগ্রাম
স্বামীর আকস্মিক শাহাদাতের পর বেগম খালেদা জিয়া যে অদমনীয় সাহস ও অনমনীয় দৃঢ়তা নিয়ে রাজনীতির ময়দানে এগিয়ে এসেছিলেন, তা বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল। ১৯৯০ সালের গণ অভ্যুত্থান থেকে শুরু করে ২০০৭-০৮ সালের অমানবিক কারাবাস কোনো পরিস্থিতিই তাঁকে দমাতে পারেনি।
গুলশানে বালুর ট্রাকে অবরুদ্ধ বাসভবন, ষড়যন্ত্র, বাধা, মিথ্যা মামলা সবকিছু মাথা উঁচু করে মোকাবিলা করেছেন তিনি। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনকাল কেউই তাঁকে নত করতে পারেনি।
শেখ হাসিনার প্রতিশোধপরায়ণতা
বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি শেখ হাসিনার গভীর ক্ষোভ কতটা তীব্র ছিল, তা ২০১৯ সালের ৩ নভেম্বর রাজধানী ঢাকার খামারবাড়ি কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে 'জেলহত্যা দিবস' উপলক্ষে আয়োজিত আওয়ামী লীগের সভায় তার বক্তব্যে স্পষ্ট হয়েছিল।
শেখ হাসিনা বলেছিলেন, "খুনিদের নিয়ে এত মায়াকান্না কেন? জেনারেল জিয়া একজন খুনি। তার স্ত্রী (বেগম খালেদা জিয়া), ছেলেও (তারেক রহমান) তা-ই। তারা শত শত মানুষকে হত্যা করেছে।"
জেলে স্লো পয়জনিং ও স্বাস্থ্য অবনতি
শেখ হাসিনার সরকারের আমলে হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলায় তাঁর দীর্ঘ কারাবাস এবং অনেকের মতে, জেলে বন্দি থাকা অবস্থায় বেগম খালেদা জিয়াকে 'স্লো পয়জনিং' করা হয়েছিল। সঠিক চিকিৎসা না হওয়ার ফলে তিনি হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিস, লিভার সিরোসিস, কিডনির জটিলতাসহ নানা শারীরিক জটিলতায় আক্রান্ত হন।
ধীরে ধীরে তাঁর দেহ ভেঙে পড়ে, পঙ্গুত্বের দিকে এগোতে থাকে। সর্বশেষ গত ২৩ নভেম্বর তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন। চিকিৎসকরা তাঁর হার্ট ও ফুসফুসে সংক্রমণ শনাক্ত করেছেন।
জিয়া পরিবারের ওপর নিপীড়ন
জিয়া পরিবারের দ্বিতীয় প্রজন্মও একই নৃশংসতার শিকার। তারেক রহমান, যিনি দলের পুনর্গঠন ও গণতন্ত্রের জন্য জনপ্রিয় নেতা হিসেবে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন ২০০১ সালে রাতের অন্ধকারে আটক হয়ে ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হন। রিমান্ডের নামে ইলেকট্রিক শক, শারীরিক নির্যাতন, শতাধিক মিথ্যা মামলা সব মিলিয়ে তাঁকে পঙ্গুত্বের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়।
রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত না থাকা সত্ত্বেও তাঁর ছোট ভাই আরাফাত রহমান কোকোর ওপরও রাজনৈতিক প্রতিশোধ চালানো হয়। মায়ের কারাবাস, বড় ভাইয়ের ওপর নির্যাতন এবং দেশহীন জীবনের দুঃখে কোকো ২০১৫ সালে মালয়েশিয়ায় মৃত্যুবরণ করেন। নিজের দেশের মাটিতে শেষ নিশ্বাস ত্যাগের অধিকারও পাননি।
তারেক রহমানের বিচক্ষণ অপেক্ষা
বর্তমানে বেগম খালেদা জিয়া যখন জীবনের কঠিন সংকট মুহূর্তে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছেন, তখন তাঁর বড় ছেলে তারেক রহমানও অসহায়। দেশে ছুটে আনতে না পেরে সন্তানের হৃদয় যেমন ব্যথায় ভারী, তেমনি একজন জাতীয় নেতার দায়িত্ববোধ তাঁকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করছে।
তিনি নিজেই জানিয়েছেন দেশে তাঁর ফেরাটা শুধু আবেগের বিষয় নয়, এটি একটি রাষ্ট্রিক সিদ্ধান্ত। দেশে চলমান অনিরাপদ পরিবেশ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, ষড়যন্ত্রের জাল এবং আন্তর্জাতিক শক্তির অস্বচ্ছ আচরণ সব মিলিয়ে তাঁর দেশে ফেরার পথ এখনো নিরাপদ নয়।
দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি
দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহভাবে অবনতি হয়েছে। ৩০ নভেম্বর একাত্তর টিভির খবর 'খুলনা আদালত চত্বরে প্রকাশ্যে দুইজনকে গুলি করে হত্যা', ১৭ নভেম্বর প্রায় সব জাতীয় দৈনিকের শিরোনাম 'মিরপুরে দোকানে ঢুকে যুবদল নেতাকে গুলি করে হত্যা'।
১৫ জুলাই ২০২৫ বাংলাদেশ টুডে-র শিরোনাম '১০ মাসে ৩৫৫৪ খুন, ৪১০৫ ধর্ষণ, ৮১৯ অপহরণ', ১৫ অক্টোবর ২০২৫ সময় টিভির খবর 'আট মাসে প্রতিদিন গড়ে ১১ জনকে হত্যা' এমন অসংখ্য শিরোনামে গণমাধ্যম ভরে যাচ্ছে।
জাতির প্রার্থনা ও দোয়া
বাংলাদেশের তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও সংগ্রামী রাজনীতির এক অনমনীয় প্রতীক বেগম খালেদা জিয়া আজ জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে নিঃশব্দে লড়ে যাচ্ছেন এভারকেয়ার হাসপাতালের সাদা দেয়ালের মাঝে।
গ্রামের মসজিদের মাইক থেকে শহরের ব্যস্ত মোড়ে দাঁড়ানো মানুষ সবাই এক সুরে দোয়া করছেন, তাঁর সুস্থতার জন্য রোজা রাখছেন, হাত তুলছেন আকাশের দিকে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও উপদেষ্টাগণ থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী এবং সাধারণ জনগণ সবার কণ্ঠে একই প্রার্থনা বেগম খালেদা জিয়া সুস্থ হয়ে ফিরে আসুন আমাদের মাঝে।
যে মহীয়সী নারী দেশকে অন্ধকার থেকে আলো দেখিয়েছেন, কখনো দেশের মানুষকে ছেড়ে যাননি, দুঃসময়ে সাহস দিয়েছেন কোটি মানুষকে। সেই জননন্দিত নারীই আজ শুয়ে আছেন জীবনের সীমানায়। তাই প্রতিটি ঘরে, প্রতিটি হৃদয়ে নেমে এসেছে নীরব স্রোতের মতো উদ্বেগ আর অশ্রুভেজা অপেক্ষা।
আজ রাজনীতি ভুলে মানুষ একত্র হয়েছে শুধু একজন মায়ের সুস্থতা কামনায়। কারণ বেগম খালেদা জিয়া কোনো সাধারণ রাজনীতিকের নাম নয় তিনি একটি ইতিহাস, একটি অনুভূতি, একটি সংগ্রামী জাতির দীর্ঘ অভিযাত্রার প্রতীক। তাঁর সুস্থতা তাই শুধু একটি পরিবারের নয় গোটা জাতির গভীর আকাঙ্ক্ষা।