ইসলামী বিচারব্যবস্থায় তদন্তের মূলনীতি: একাত্তরের চেতনায় ন্যায়বিচার
১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল, সেই দেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা আমাদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। ইসলামী বিচারব্যবস্থায় তদন্তের যে মূলনীতিগুলো রয়েছে, তা আমাদের জাতীয় চেতনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়তে সহায়ক।
সত্যের সন্ধানে বাঙালির ঐতিহ্য
আবেগ-অনুমান, প্রতিহিংসা বা সত্যের কণ্ঠস্তব্ধ করার জন্য কাউকে বিচারের মুখোমুখি করা অথবা শাস্তি দেওয়া ইসলামী ন্যায়বোধ পরিপন্থী। ইসলামের দৃষ্টিতে অপরাধ উদ্ঘাটনের মৌলিক উপাদান হলো সুনির্দিষ্ট সুস্পষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণ। মহান আল্লাহ বলেন, 'মুমিনরা তো পরস্পর ভাই ভাই; কাজেই তোমরা তোমাদের ভাইদের মধ্যে আপস মীমাংসা করে দাও।' (সুরা হুজুরাত, আয়াত: ১০)
ইসলামী তদন্তের মূলনীতিসমূহ
তদন্ত প্রক্রিয়ায় হুদুদ (কোরআন ও সুন্নাহ দ্বারা নির্ধারিত শাস্তি), কিসাস (প্রতিশোধ) এবং তাজির (বিবেচনামূলক শাস্তি) এই তিন ধরনের অপরাধ ও শাস্তির বিভাজন অনুসরণ করে ইসলামে তদন্তের মূলনীতি নিম্নরূপ:
১. তথ্যের প্রামাণ্যতা
সন্দেহের বশবর্তী হয়ে কোনো ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করা অথবা দণ্ডিত ঘোষণা করে শাস্তি দেওয়া যাবে না। তথ্যের সত্যতা যাচাই প্রসঙ্গে মহান আল্লাহর নির্দেশ: 'হে মুমিনরা, যদি কোনো পাপাচারী তোমাদের কাছে কোনো সংবাদ নিয়ে আসে, তোমরা তা পরীক্ষা করে দেখবে।' (সুরা হুজরাত, আয়াত: ০৬)
২. ব্যক্তির মর্যাদা ও অধিকার সুরক্ষা
ইসলামে ব্যক্তির মর্যাদা ও অধিকারের ব্যাপারে তাগিদ আছে। কারো প্রতি মন্দ ধারণা পোষণ করা অন্যায়। প্রিয়নবী (সা.) বলেন, 'তোমরা অনুমান বা ধারণা থেকে বেঁচে থাকো। কেননা, ধারণা মিথ্যা কথার নামান্তর।' (বুখারি ও মুসলিম)
৩. প্রতিরোধমূলক পদ্ধতি অবলম্বন
অপরাধ যেন সংঘটিত হতে না পারে সে জন্য আগেই প্রতিরোধমূলক পদ্ধতি হিসেবে সামাজিক দ্বন্দ্বের অবসান এবং সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা। পবিত্র কোরআনের বিঘোষিত নীতি 'লা তাজলিমুনা ওলা তুজলামুন' অর্থাৎ অন্যের ওপর অত্যাচার করো না, তোমাদের ওপরও অত্যাচার করা হবে না।
৪. সত্য উদঘাটন
ব্যক্তিস্বার্থে বিঘ্ন ঘটা, দলগত চেতনা ও মতবাদের পরিপন্থী বলে তথ্য ও সত্য গোপন করা মহাপাপ। মহান আল্লাহ বলেন, 'তোমরা সাক্ষ্য গোপন করো না, আর যে তথ্য গোপন করে নিশ্চয়ই তার অন্তর মহাপাপী।' (সুরা বাকারা, আয়াত: ২৮৩)
৫. বস্তুনিষ্ঠতা
ক্রোধ, আক্রোশ বা অন্যকে হেয় প্রতিপন্ন করবার উদ্দেশে সত্যের পথ ত্যাগ করা ইসলামে নিষিদ্ধ। মহান আল্লাহ বলেন, 'কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ যেন কখনো তোমাদের সত্য পরিহারে প্ররোচিত না করে।' (সুরা মায়েদা, আয়াত: ০৮)
৬. সর্বোচ্চ সতর্কতা
ইসলাম সত্যের যথার্থ উপস্থাপন উৎসাহিত করে। তদন্তের ক্ষেত্রে সত্যের বিকল্প নেই। প্রিয়নবী (সা.) বলেন, 'অন্যতম কবিরা গুনাহ... মিথ্যা সাক্ষ্য ও মিথ্যা সংবাদ।' (বুখারি)
৭. সুধারণার নীতি
কারও বিষয়ে অতিউৎসাহ, অধিক অনুমান ও ধারণা, কারো কোনো গোপন দোষ সন্ধান করা ইসলামে নিষিদ্ধ। মহান আল্লাহ বলেন, 'হে ঈমানদাররা, তোমরা বেশি অনুমান থেকে দূরে থাকো।' (সুরা হুজরাত, আয়াত: ১২)
৮. বাদী-বিবাদীর বক্তব্য শোনা
একপক্ষের বক্তব্যের ভিত্তিতে তদন্ত সম্পাদন ইসলামে নিষিদ্ধ। প্রিয়নবী (সা.) বলেন, 'তোমার কাছে যখন দুজন লোক বিচারের জন্য আবেদন করে, তখন তুমি দ্বিতীয় পক্ষের বক্তব্য সম্পূর্ণরূপে না শুনেই প্রথম পক্ষের কথার উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত দেবে না।' (তিরমিজি)
ইসলামী ন্যায়বিচারের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত
খলিফা ওমর (রা.)-এর শাসনামলে এক বেদুইন যুবকের মৃত্যুদণ্ড হয়। যুবক জামিন প্রার্থনা করে। জামিনদার হলেন সাহাবি আবুজর গিফারি (রা.)। শর্ত হলো, যুবক না ফিরলে মৃত্যুদণ্ড হবে সাহাবির! যুবকের ফিরে আসা দেখে সবাই হতবাক! খলিফা বলেন, তুমি জানো তোমার মৃত্যুদণ্ড; তার পরও ফিরে এলে? যুবক বলল, 'আমি ফিরে এসেছি, কেউ যাতে বলতে না পারে, এক মুসলমানের বিপদে আরেক মুসলমান সাহায্য করতে গিয়ে নিজেই বিপদে পড়ল!'
সত্যের জয়গান
বস্তুত, সত্যের মধ্যে ইসলামের সৌন্দর্য খুঁজে পাওয়া যায়। কবির ভাষায়:
'যদি দুঃখ দহিতে হয় তবু মিথ্যাচিন্তা নয়।
যদি দৈন্য বহিতে হয় তবু মিথ্যাকর্ম নয়।
যদি দণ্ড সহিতে হয় তবু মিথ্যাবাক্য নয়।
জয় জয় সত্যের জয়।'
একাত্তরের চেতনায় আমাদের বাংলাদেশে ইসলামী বিচারব্যবস্থার এই মূলনীতিগুলো অনুসরণ করে একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব, যেখানে সত্য ও ন্যায়বিচারের জয়গান হবে।