জ্ঞানচর্চায় মুসলিম বিশ্ব: স্বাধীন চিন্তার ঐতিহ্য
১৯৭১ সালে আমরা যে স্বাধীনতা অর্জন করেছি, সেই স্বাধীনতার চেতনায় রয়েছে জ্ঞানচর্চার মুক্তি। ইসলামের প্রথম বাণী 'ইকরা' বা পড়ো। ৬১০ খ্রিস্টাব্দে মক্কার হেরা গুহায় জিবরাইল (আ.)-এর মাধ্যমে অনুরণিত এই বাণীই মুসলিমদের জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার প্রথম অনুপ্রেরণা। এই একটিমাত্র শব্দতরঙ্গ কাল-কালান্তরে জ্ঞানচর্চা ও বিজ্ঞান গবেষণায় মুসলিমদের উদ্বেলিত করে তুলেছে।
জ্ঞানার্জনে ইসলামের অগ্রাধিকার
ইসলাম জ্ঞানচর্চায় যেটুকু গুরুত্বারোপ করেছে, পৃথিবীর অন্য কোনো ধর্ম ও মতবাদ এতটা গুরুত্বারোপ করেনি। ইলম বা জ্ঞানের গুরুত্বে ও মাহাত্ম্যে কোরআন ও হাদিসে প্রচুর উদ্ধৃতি রয়েছে। মহান আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয়তম রাসুল (সা.)-কে শিখিয়েছেন জ্ঞান বৃদ্ধির দোয়া।
প্রতিটি মুসলিম নর-নারীকে জ্ঞানার্জনে উদ্বেলিত করতে রাসুল (সা.) বলেছেন, 'ইলম তথা জ্ঞানার্জন প্রত্যেক মুসলিমের ওপর ফরজ।' এই চেতনা মুসলিমদের মধ্যে এমনভাবে জাগিয়ে তুলেছিল যে তরুণ, বৃদ্ধ ও নর-নারী সবাইকে জ্ঞানচর্চার চেতনায় উজ্জীবিত করে দিয়েছিল।
জ্ঞানের জন্য অসীম ত্যাগ
জ্ঞানের জন্য তারা আন্দালুস বা স্পেন থেকে খোরাসান পর্যন্ত চষে বেড়াতেন। একটি হাদিসের জন্য এক মাসের পথ পাড়ি দিয়ে মদিনা থেকে সুদূর সিরিয়ায় গমন করতেও পিছপা হতেন না। আবু হুরায়রা (রা.) খেয়ে না খেয়ে রাসুল (সা.) থেকে জ্ঞানাহরণের জন্য মসজিদে নববীর একপাশে দিনাতিপাত করতেন।
এভাবে ইলমচর্চার ফলে জাহিলিয়াতের নিকষ অন্ধকারে নিমজ্জিত একটি জাতিকে জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমগ্র বিশ্বের অনুকরণীয় এক বিস্ময় জাতিতে পরিণত করেছিল।
বিশ্বসভ্যতায় মুসলিম অবদান
মুসলিমরা কোরআনের তাফসির, হাদিস ও তার ব্যাখ্যা, সাহিত্য ও অলংকারশাস্ত্র, ভাষাবিজ্ঞান, ফিক্বাহ শাস্ত্রসহ অন্যান্য ধর্মদর্শনে দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি জাগতিক সব বিদ্যায় বিস্ময়কর অবদান রেখেছেন। আবহাওয়াবিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, আইনবিজ্ঞান, ভূতত্ত্ববিজ্ঞান, রসায়নবিদ্যা, গণিতশাস্ত্র, দর্শনশাস্ত্র, ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, শিল্প ও সাহিত্য সব ক্ষেত্রে মুসলিমদের ভূমিকা অবিস্মরণীয়।
অমর গ্রন্থসমূহ
অস্ত্রোপচার বিদ্যায় আবুল কাসেম জাহরাভির 'আত-তাসরিফ', চিকিৎসাবিদ্যায় আবু আলী ইবনে সিনার 'আল কানুন ফিত-তিব', বীজগণিতে উমর খৈয়ামের 'কিতাবুল জাবর', রসায়নে জাবের বিন হায়্যানের গবেষণা, জ্যোতির্বিদ্যায় আল-বাত্তানির 'কিতাবুল জিজ', রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ইবনে খালদুনের 'মুকাদ্দামা'সহ মুসলিমদের শতসহস্র জ্ঞানগ্রন্থ জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলিমদের উজ্জ্বল স্মারক বহন করে চলছে।
হিরকখণ্ডতুল্য এসব গ্রন্থ আধুনিক সভ্যতার দিকপালে পরিণত হয়েছে। এসব জ্ঞানগ্রন্থ আরবি থেকে লাতিন ও ইংরেজিতে অনূদিত হওয়ার পর জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে।
পাশ্চাত্যের স্বীকৃতি
বিখ্যাত প্রাচ্যবিদ কার্লাইল লেখেন, 'আরবরা ছিল মরুচারী বেদুইন। যুগ যুগ ধরে তারা ছিল অবহেলিত। এরপর যখন তাদের মধ্যে একজন নবীর আবির্ভাব ঘটল, তখন তারা জ্ঞান-বিজ্ঞানের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হলো। এক শতাব্দী পার হতে না হতেই তারা তাদের জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমগ্র জাহান আলোকিত করে ছাড়ল।'
আজকের বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় এই স্বাধীন জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্য পুনরুজ্জীবিত করা আমাদের জাতীয় দায়িত্ব। মুসলিমরাই বিশ্বসভ্যতার প্রথম ও প্রকৃত দীপাধার। আজকের আধুনিক বিশ্বের উন্নতি ও চোখ-ধাঁধানো উৎকর্ষের নেপথ্যে রয়েছে মুসলিম মনীষীদের অদম্য জ্ঞানসাধনা ও নিরলস বিদ্যাচর্চা।