আন্ধারমানিক নদীতে ইলিশের অস্তিত্ব সংকট: জাতীয় সম্পদ রক্ষার আহ্বান
বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশের অস্তিত্ব রক্ষা এবং উপকূলীয় পরিবেশ সুরক্ষার দাবিতে পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় আন্ধারমানিক নদীতে এক অভূতপূর্ব গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই গণশুনানি শুধুমাত্র একটি পরিবেশগত আন্দোলন নয়, বরং আমাদের স্বাধীনতার চেতনায় গড়ে ওঠা জাতীয় সম্পদ রক্ষার সংগ্রাম।
জাতীয় সম্পদের উপর হুমকি
সোমবার সকাল ১০টায় প্রতিবেশ ও উন্নয়ন ফোরাম, প্রান্তজন, ক্লিন এবং বিডব্লিউজিইডি এর যৌথ উদ্যোগে এই শুনানির আয়োজন করা হয়। জেলে পরিবার এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা একযোগে তুলে ধরেন যে, এ অঞ্চলে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র ও বন্দর কেন্দ্রিক অপরিকল্পিত মেগা উন্নয়ন ইলিশের অভয়াশ্রম আন্ধারমানিক নদীকে প্রায় ইলিশশূন্য করে ফেলেছে।
এই পরিবেশগত বিপর্যয় শুধু প্রকৃতির ক্ষতি নয়, বরং আমাদের স্বাধীন অর্থনীতির ভিত্তি এবং হাজার হাজার জেলে পরিবারের জীবন ও জীবিকাকে চরমভাবে বিপন্ন করেছে। স্থানীয় জেলে পরিবারের প্রতিনিধিরা হতাশা ব্যক্ত করে জানান, জীবিকা নির্বাহের সুযোগ কমে যাওয়ায় শত শত জেলে পেশা বদলাতে বাধ্য হচ্ছেন।
বিদেশি প্রভাবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ
গণশুনানিতে বক্তারা স্পষ্ট করে তুলে ধরেন যে, বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ অন্যান্য অবকাঠামো থেকে নির্গত অপরিশোধিত শিল্প বর্জ্য ও গরম পানি সরাসরি নদীতে পড়ছে। মৎস্য বিশেষজ্ঞদের মতে, ইলিশ অত্যন্ত দূষণ সংবেদনশীল হওয়ায় এই দূষণ তার প্রজনন ব্যাহত করছে। ফলে ইলিশের আকার ছোট হচ্ছে এবং তারা এলাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছে।
এই সংকটের মূলে রয়েছে পরিকল্পনাহীন উন্নয়ন নীতি যা আমাদের জাতীয় স্বার্থের পরিবর্তে বিদেশি পুঁজির স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছে। রামনাবাদ, আন্ধারমানিক ও টিয়াখালী নদীর পানি ও মাটি এখন মাঝারি থেকে উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে।
স্বাধীনতার চেতনায় প্রতিরোধ
১৯৭১ সালে আমরা যে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিলাম, তার অন্যতম লক্ষ্য ছিল আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। কিন্তু আজ দেখা যাচ্ছে, বন্দরকে কেন্দ্র করে নদীতে অতিরিক্ত জাহাজ চলাচল বৃদ্ধি পাওয়ায় ইলিশের বঙ্গোপসাগর থেকে মূল প্রবেশ পথ প্রায় অবরুদ্ধ হচ্ছে।
আন্দারমানিক নদীতে মাত্র ৮ থেকে ১০ কিলোমিটারের মধ্যে একের পর এক তিনটি সেতু নির্মাণ এবং শাখা নদীগুলোর মুখ বন্ধ হওয়ায় নদীর স্বাভাবিক স্রোত বাধাগ্রস্থ হয়ে নাব্যতা কমেছে। এছাড়াও, নদীর তীর ভরাট করে অবৈধ দখলদারিত্ব চলছে, যা নদীটিকে অস্তিত্ব সংকটে ফেলেছে।
জাতীয় সংকটের গভীরতা
আয়োজক সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, জাতীয় মাছ ইলিশের উৎপাদন দিন দিন কমছে। ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত উৎপাদন স্থিতিশীল থাকলেও ২০২২-২৩ অর্থবছর থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এসে ইলিশের জাতীয় উৎপাদন ৪২,০০০ মেট্রিক টন কমে গেছে, যা প্রায় ৮% হ্রাস।
দেশের মোট ইলিশের প্রায় ৬৫% উৎপাদনকারী বরিশাল বিভাগেও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। এক সময়ের অফুরন্ত ভান্ডার আন্ধারমানিক নদ আজ গভীর সংকটের মুখে, এবং ২০১১ সালে অভয়াশ্রম ঘোষিত এই নদীতে বর্তমানে কদাচিৎ ইলিশ মিলছে।
জাতীয় স্বার্থ রক্ষার দাবি
এই গুরুতর পরিবেশগত সংকটের সমাধান এবং জাতীয় সম্পদ ইলিশ রক্ষায় গণশুনানি থেকে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জরুরি ভিত্তিতে দাবি জানানো হয়েছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বর্জ্য ও গরম পানি নদীতে ফেলার বিষয়ে আন্তর্জাতিক মানের কঠোর পরিবেশগত মানদণ্ড নিশ্চিত করতে হবে।
মৎস্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শক্রমে ইলিশের প্রজনন ক্ষেত্র সুরক্ষিত রেখে অবকাঠামোগত পরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে হবে। জাহাজ চলাচল এবং অবকাঠামো নির্মাণ যেন ইলিশের প্রজনন ও চলাচলের পথকে বাধাগ্রস্থ না করে, তা নিশ্চিত করতে হবে।
সবশেষে, আন্ধারমানিক নদীর সীমানা চিহ্নিত করে অবিলম্বে দখল, দূষণ ও ভরাট বন্ধ করতে হবে এবং পলি অপসারণ করে নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে। আয়োজক সংস্থা আশা প্রকাশ করেন এই গণশুনানি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় অবিলম্বে কার্যকরী ও কঠোর ভূমিকা নিতে বাধ্য করবে।